জাফর ইকবাল
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন
বক্তা হিসেবে দেয়া (জাফর ইকবাল) ড. মুহম্মদ
জাফর ইকবালের
বক্তব্য
কিন্তু তার হাড়ভাঙ্গা খাটুনির অর্থ দিয়ে তোমাদের লেখাপড়া করিয়েছে। এখন
তোমরাই ঠিক করো তোমার এই শিক্ষাটুকু দিয়ে তুমি কার জন্যে কী করবে!কিছু দিন আগে
খবরের কাগজের একটি প্রতিবেদন চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমাকে একটি সত্য নূতন করে
জানিয়ে দিয়েছে।সত্যটি হল আমাদের দেশ অর্থনৈতিক ভাবে অনেক এগিয়ে এসেছে আর
এই এগিয়ে যাওয়ার পিছনে রয়েছে দেশের তিন ধরণের মানুষ।গার্মেন্টেসের শ্রমিকরা- যার
বেশীরভাগই হচ্ছে মেয়ে- অর্ধ সহস্রাধিক* সেই গার্মেন্টস শ্রমিকদের আমরা সাভারে
নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছি।প্রবাসী শ্রমিক- যারা নিজের আপনজনকে দেশে ফেলে নির্বান্ধব
পরিবেশে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এবংএই দেশের কৃষক যাদেরকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার
জন্যে আমরা আমাদের ভাষায় চাষা নামক একটা শব্দ তৈরী করে রেখেছি।আমি রীতিমত
ধাক্কা খেয়েছি যখন আবিষ্কার করেছি- যারা এই দেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে আমি
তাদের কেউ নই তাদের কারো সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই- আমি তাদের জন্যে কখনো
কিছু করিনি।
আমার মনে হয়েছে আমি বুঝি এই দেশের বোঝা, এই দেশের গার্মেন্টেসের
মেয়েরা, প্রবাসী শ্রমিকেরা আর মাঠে ঘাটের চাষীরা আমাকে সুন্দর একটা জীবন উপহার
দিয়েছে- প্রতিদানে আমি তাদের কিছু দিই নি।আমি তখন নিজেকে বুঝিয়েছি, দেশের
অর্থনীতিকে এখন গার্মেন্টেসের মেয়েরা, প্রবাসী শ্রমিক এবং চাষীরা সচল রেখেছে, তারা
একটি গাড়ীর তিনটি চাকার মতো-গাড়ীটি সত্যিকার ভাবে ছুটতে পারবে যখন তার সাথে চতুর্থ
চাকাটি জুড়ে দেয়া হবে। সেই চতুর্থ চাকা কোনটি?তোমরা হচ্ছ সেই চতুর্থ চাকা, জ্ঞান বিজ্ঞান
এবং প্রযুক্তিতে বলীয়ান আমাদের নূতন প্রজন্ম।আমি বুভুক্ষের মতো অপেক্ষা করে আছি
তোমাদের মেধা মনন এবং সৃজনশীলতা নিয়ে কখন তোমরা এই দেশের শ্রমজীবী মানুষের
পাশে এসে দাড়াবে।কখন মানুষের শরীরের ঘাম অপসারিত হবে মস্তিষ্কের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে।
তোমরা কী জান, এটি তোমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়?তোমরা কী জান তোমাদের চোখে
রয়েছে রঙিণ চশমা, আমাদের চোখে যেটি একেবারেই সাদামাটা তোমাদের চোখে সেটিই
বিচিত্র বর্ণে উজ্জল?তোমরা কী জান এখন তোমাদের জীবনকে উপভোগ করার সময়?
তোমরা কী জান জীবনকে কীভাবে সবচেয়ে বেশী উপভোগ করা যায়?তোমাদের সবারই
নিশ্চয়ই এই বিষয়ে নিজের একটা ভাবনা আছে- আমি তোমাদের সাথে আমার জীবনের
অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া আমার ভাবনাটুকু বিনিময় করি।নিজের জন্যে যখন কিছু একটা
করি তখন অবশ্যই আমাদের একধরণের আনন্দ হয় কিন্তু তার থেকে শতগুণ বেশী আনন্দ
হয় যখন আমরা অন্যের জন্যে কিছু করি!তোমাদের ভেতর যারা বন্যা পীড়িত মানুষের কাছে
গিয়ে তাদের হাতে একটুখানি ত্রাণ তুলে দিয়েছ তখন তাদের মুখে যে হাসিটুকু দেখেছ আমি
জানি সেটি তুমি কখনো ভুলবে না।তুমি যখন রক্ত দিয়েছ সেই রক্তের ব্যাগ থেকে
ফোটাফোটা রক্ত গিয়ে যখন একজন মূমূর্ষ বিবর্ণ রোগীর মুখে জীবনের স্পন্দন দিয়ে এসেছে,
আমি জানি তুমি সেই আনন্দের কথা কখনো ভুলতে পারবে না।তুমি যখন তোমার
ক্যাম্পাসের পথে ঘাটে পাতা কুড়ানো হতদরিদ্র শিশুটিকে বারান্দায় বসিয়ে বর্ণ পরিচয়
করিয়েছ তুমি নিশ্চয়ই সেই আনন্দটির কথাও কখনো ভুলতে পারনি।যখন গণিত
অলিম্পিয়াডে গিয়ে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে স্কুল কলেজের ছেলে মেয়েদের সাহায্য করেছ তখন
তাদের উজ্জল চোখের দৃষ্টিটি নিশ্চয়ই তুমি ভুলতে পারনি।যারা এখনো সেই তীব্র আনন্দের
স্বাদ উপভোগ করোনি তাদের আমি মনে করিয়ে দিতে চাই- জীবনটিকে একেবারে কানায়
কানায় উপভোগ করার এখনই সময়।অন্যের জন্যে কিছু করে জীবন উপভোগ করার এই
পথটুকুর সন্ধান পেতে পেতে আমার অনেক সময় পার হয়ে গিয়েছিল- আমি কিন্তু তোমাদের
অনেক আগেই বলে দিয়েছি!
আমার এই দীর্ঘ জীবনে আমি অনেক মানুষকে দেখেছি,
অনেকের সাথে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে,সবাইকে নিয়ে আমি অনেক কিছু করেছি।
আমার এই দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে আমি খুব সোজা সাপ্টা একটা বিষয় আবিষ্কার করেছি; সেটি
হচ্ছে পৃথিবীর মানুষ দুই রকম!এক ধরনের মানুষের সব কিছুতে উৎসাহ, সব সময়েই তারা
নূতন কিছু করার জন্যে ব্যস্ত।সব সময়েই তারা কিছু না কিছু করছে, একশটা জিনিস করতে
গিয়ে তারা অনেক সময়েই ঘোট পাকিয়ে ফেলছে, সমস্যায় পড়ে যাচ্ছে- তারপরেও তাদের
উৎসাহে কোনো অভাব নেই।অন্য ধরনের মানুষের কোনো কিছুতে উৎসাহ নেই, তারা
নিস্পৃহ, তাদের তাপ উত্তাপ নেই।তারা নূতন কিছু করে না, তাই তাদের জীবনে ভূলও হয় না।
তাদের নিস্তরঙ্গ জীবনে উত্তেজনা নেই, উচ্ছ্বাস নেই।আমি তোমাদের আরও একটি সত্যের
সন্ধান দিয়ে যাই- এই পৃথিবী, দেশ কিংবা সমাজটাকে চলায় প্রথম গোষ্ঠী যাদের সব কিছুতে
উৎসাহ!পৃথিবীর যত বড় কাজ সব করেছে এই উৎসাহী প্রজন্ম।তোমাদের ভেতর যারা এই
উৎসাহীদের দলে আমি জানি তোমাদের অতি উৎসাহের কারনে অনেক সময় তোমার ক্ষতি
হয়েছে,অনেক গুরুজন তোমাকে নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে নিষেধ করেছেন,ভূল
সিদ্ধান্ত নিয়ে তোমরা অনেকবার বিপদে পড়েছ।আমি তোমাদের আস্বস্ত করতে চাই দেখবে
তোমরাই কিন্তু সব কিছুতে নেতৃত্ব দেবে,তোমার আঙ্গুলি হেলেনে সবাই তোমার পিছনে এসে
দাড়াবে।
তোমাদের ভিতর যারা উৎসাহকে রাশ টেনে নামিয়ে সতর্ক ভাবে পা
ফেলেছে,উৎসাহী বন্ধুদের একশ রকম কাজ দেখে বিরক্ত হচ্ছে,সমালোচনা করেছে
তাদেরকে বলে রাখি এই উৎসাহটুকুই কিন্তু সফল আর অসফল মানুষের মাঝখানে বিভাজন।
তোমরা ঠিক করো মাপা উৎসাহ নিয়ে বিভাজনের নিচে দাড়াবে নাকি তীব্র উৎসাহের বান
ডাকিয়ে বিভাজনের উপরে গিয়ে দাড়াবে।আজ তোমাদের একটি ছাত্র জীবনের সমাপ্তি
হয়েছে।তোমার মূল্যায়ন করতে গিয়ে তোমাদেরকে অসংখ্যবার পরীক্ষা দিতে হয়েছে, সেই
পরীক্ষায় তুমি তোমার সহপাঠীর সাথে প্রতিযোগিতায় নেমেছ,সেই প্রতিযোগিতায় তোমরা
কেউ কেউ তোমাদের সহপাঠীদের পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছ।আমি তোমাদের মনে
করিয়ে দিতে চাই সত্যিকারের জীবন কিন্তু প্রতিযোগিতার জীবন নয়।যেখানে কিন্তু কাউকে
ঠেলে পেছনে ফেলে তোমায় এগিয়ে যেতে হবে না।সত্যিকারের জীবন হচ্ছে সহযোগিতার।
সত্যিকার জীবনে তুমি যখন সত্যিকারের কাজ করবে তখন তোমরা একে অন্যের সাথে
পাশাপাশি থেকে সাহায্য করবে।সেখানে কোনো প্রতিযোগিতা নেই। প্রতিযোগিতা শুধু একটি
জায়গায় থাকে- সেটি হচ্ছে নিজের সাথে প্রতিযোগ



0 মন্তব্যসমূহ